হাইড্রা হেডেড মনস্টার

হাইড্রা হেডেড মনস্টার। বহুমাথার দানব। গ্রিক উপকথার গল্প। এই দৈত্যের ছিল অনেক মাথা। একটা মাথা কাটলে দুটো মাথা গজিয়ে যেতো সেখানে। আমরা এখন তেমন বহুমাথার দানবের কবলে। একেকটা মাথা একেক রকম অপরাধ করে যাচ্ছে। কেউ করে গুম, খুন, সন্ত্রাস। কেউ করে দুর্নীতি, দখল, লুটপাট। কারো হাতে হাতুড়ি, চাপাতি, হকিস্টিক, পিস্তল। কারো হাতে গুলী, বন্দুক, কাঁদুনেগ্যাস। কেউ ক্যাসিনো চালায়। কেউ শেয়ারবাজার, ব্যাংক লুটে খায়। কেউ টেন্ডার দখল করে। কেউ সরকার-কা-মাল ঢেলে পর্দা-বালিশ কেনে হাজার গুণ বেশি দরে। কেউ ঘুষ খেয়ে সম্পদের পাহাড় গড়ে। কেউ পুকুর খোঁড়া শিখতে দেশ-দুনিয়া সফরে বেরোয়। কেউ জনগণের অর্থকে 'গৌরি সেনের টাকা' ভেবে নিজের দেরাজে ভরে। কেউ দেশের স্বার্থ বিকিয়ে ক্ষমতার গ্যারান্টির সিলমোহর কিনে আনে। এরকম একেক মাথার একেক কাজ হলেও দানব কিন্তু আসলে একটাই।

এই দানবের একটা মাথা আছে কেবলই প্রোপাগান্ডার জন্য। এদের হাতে অস্ত্রপাতি নেই, দেখতে নিরীহ। কিন্তু এরা বহুমাথার দানবের অন্যান্য মাথার চেয়ে মোটেই কম ক্ষতিকারক নয়।

আপনার আমার আশেপাশেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে দানবের এই প্রোপাগাণ্ডা মিশনের গুপ্ত সদস্যরা। এদের এসাইনমেন্ট দানবের দানবিকতাকে আড়াল করা। এদের মূল উদ্দেশ্য জুলুম-পীড়নের দানবকে রক্ষা করা। এদের কাজ যখন যেমন তখন তেমন প্রোপাগান্ডা চালিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করা।

এদেরকে দেখবেন স্যাট টিভির নিউজরুমে, রিপোর্টার বেশে মাঠে-ময়দানে, টক শোতে, খবরের কাগজের অফিসে, কলামনিস্ট সেজে কলাম লিখতে। এদেরকে সভায়-আলোচনায় বুদ্ধিজীবী বেশে পাবেন। দেখবেন এদেরকে সোশ্যাল মিডিয়ায় স্ট্যাটাস দিতে, কমেন্ট করতে। নিরপেক্ষতার মুখোশ এঁটেও এদেরকে হাজির হতে দেখবেন।

দানবের অন্য মাথাগুলো তো অবাধে রাতদিন হরেক রকম অপকর্ম করেই যাচ্ছে। যখনই কোনো গুরুতর অন্যায়-অপরাধের বিরুদ্ধে মানুষ সোচ্চার হয় তখনই দেখবেন প্রোপাগান্ডার মাথাটাকে খুব বেশি সক্রিয় হয়ে উঠতে।
কোনো অন্যায়কে সরাসরি সমর্থন দেয়া না গেলে এরা কৌশল বদলায়। ভেক ধরে। সহানুভূতিশীল সাজে। অন্যায়ের মেকি প্রতিবাদ জানায়। দুঃখ প্রকাশ করে। তারপর তারা "এবং, যেহেত, সুতরাং, কিন্তু, অতএব" ইত্যাদি শব্দ লাগিয়ে শুরু করে বিভ্রান্তি ছড়ানো। পাঁক ঘেটে নানা গল্প বের করে। খুঁড়ে তুলে আনে অতীতের কোনো একটা কাহিনী। বলতে থাকে, এমন অন্যায় নতুন কিছু না, সেই কোম্পানির আমলেও এমন একটা  ঘটনা ঘটেছিল।

এরা অন্যায়ের বিরুদ্ধে দেশের মানুষের বা তরুণ সমাজের যে-কোনো প্রতিবাদ দেখেই ভয় পায়। তাই তাদের প্রচারণার উদ্দেশ্যই থাকে প্রতিবাদীদের বিভ্রান্ত ও বিভক্ত করা। প্রতিবাদকে দুর্বল ও ব্যর্থ করে দেয়া।
এদেরকে চিনতে হলে এদের প্রচারের কৌশলটা খুব ভালো করে খেয়াল করতে হবে।

এরা বলবে, হ্যাঁ, এটা খুব অন্যায় হয়েছে। তবে অমুকের ওপর ভরসা রাখুন। তার রাজত্বে অন্যায় করে কেউই কিন্তু পার পাবেনা।

এরা বলবে, অন্যায়কারীরা আমাদের আদি, আসল ও সহি লোক নয়। আমরা আদর্শবাদী। আমাদের খাঁটি লোক হলে ওরা এমনটা করতো না। আসলে এরা হচ্ছে অনুপ্রবেশকারী। অন্যগ্রহ থেকে এসেছে, কিংবা এরা হাইব্রিড। খুঁজে বের করতে হবে, এদের সাথে কোনো ষড়যন্ত্রকারীর নিশ্চয়ই কানেকশন আছে।
এরা বলবে, কাজটা খুব খারাপ হয়েছে। তবে তদন্ত হচ্ছে, বিচার হবেই। এখন একদম চুপ। কথা বললেই তদন্ত ও বিচার প্রভাবিত হবে।

এরা বলবে, আর সকলের প্রতিবাদ ঠিক আছে। কিন্তু অমুকে প্রতিবাদ করলো কেন? তার উদ্দেশ্য  খারাপ। তাকে নিয়ে সন্দেহ আছে। তাই মনে হচ্ছে, ডাল মে কুছ কালা হ্যায়।

এরা বলবে, প্রতিবাদ তো হতেই পারে। তবে এর মধ্যে রাজনীতি ঢুকে গেছে। ঘোলাপানিতে কাউকেই মাছ শিকার করতে দেয়া যায়না।

এরা মূল ইস্যু ও দানবকে আড়াল করে দাঁড়িয়ে বলবে, এর দায় আসলে কিন্তু অমুক তমুক পার্টিরই বেশি। ওরা কেন এদেরকে ক্ষমতায় থাকতে দিয়েছে? যুদ্ধ করে কেন দানব বধ করতে পারেনি? ওদের ব্যর্থতার জন্যই তো এসব ঘটতে পারছে। তাই আসেন, আগে অমুক পার্টির বারোটা বাজাই। দানবের বিরুদ্ধে পরেও কথা বলা যাবে।

এরা বলবে, ভাইরে এসব চলবেই। আগেও হয়েছে, এখনো হচ্ছে, ভবিষ্যতেও হবে। যে যায় লঙ্কায় সেই হয় রাক্ষস। সবাই মুদ্রার এপিঠ আর ওপিঠ।
এরা নিজেকে আপনার কাতারের সাধারণ মানুষ হিসেবে জাহির করে উপদেশ দেবে, খামাখা নিজের বিপদ ডেকে আনার বদলে আসেন, চুপ থাকি। আমরা ভাই ছা-পোষা মানুষ, বালবাচ্চা আছে। আমাদের কি কোনো ঝুঁকি নেয়া সাজে?

এরা এর সাথে ওর তুলনা করে চলমান প্রতিবাদকে নিরুৎসাহিত করবে। মানুষকে তার অধিকারের কথা বলা থেকে বিরত রাখবে।
এরা অন্য একটা সাইড ইস্যু টেনে এনে বা একটা খুচরা ইস্যুতে বিতর্ক সৃষ্টি করে যে ঘটনায় বাদ-প্রতিবাদ হচ্ছে সেটাকে সাপ্রেস করার বা মূল ফোকাস অন্যদিকে সরাবার চেষ্টা চালাবে।

এরা বলবে, প্রতিবাদ ঠিক আছে কিন্তু তাই বলে আমরা এ থেকে অন্য কাউকে ফায়দা হাসিলের সুযোগ নিতে দিতে পারিনা। খেয়াল রাখেন, আগে খুঁজে দেখেন এই প্রতিবাদের নেপথ্যে কারা!
দানবের মাথার এই গুপ্ত সদস্যদের প্রচারণায় কিছু ক্ষিপ্ত ও হতাশ মানুষ এবং কিছু কমবুঝ লোক বিভ্রান্ত হয়ে ওদের ফেউ হয়ে যায়। কোরাস ধরে: 'সহমত ভাই', 'ঠিক বলেছেন স্যার।'

এভাবেই নির্বিঘ্নে চলতে থাকে বহুমাথার দৈত্যের দৌরাত্ম্য। ইতিহাস বলে, হাইড্রা হেডেড মনস্টারকে একটা দল বা এদলে সেদলে বধ করতে পারেনা। তারা কখনো এ দানবের একটা-দুটো মাথা কাটতে পারলেও সাথে সাথে সেখানে অটোমেটিক্যালি গজিয়ে যায় দুটো মাথা।

বহু রক্তপাত, অন্যায়, অনাচারের দানব হাইড্রা হেডেড মনস্টারকে শেষপর্যন্ত বধ করেছিলেন বীর অর্ধদেবতা হারকিউলেস। আমাদের হারকিউলেস হচ্ছেন, বাংলাদেশের বীর জনসাধারণ। এখনো তারা ঘুমন্ত। সবাই মিলে সেই হারকিউলেস-কে সেই দীর্ঘ নিদ্রা থেকে জাগিয়ে দিন।
দানব বধের শক্তি নিয়ে জেগে ওঠো হারকিউলেস! 🏇

Comments

Popular posts from this blog

উপসংহার

আহমদ ছফা

বাংলাদেশী সঙ্গীতের বরপুত্র : হ্যাপী আখন্দ