বাংলাদেশী সঙ্গীতের বরপুত্র : হ্যাপী আখন্দ

হ্যাপী আখন্দ একজন বাংলাদেশী গায়ক এবং সংগীত আয়োজক। তাঁকে বাংলাদেশী সঙ্গীতের বরপুত্র বলা হত। তিনি আর ডি বর্মণ,আববাসউদ্দীন,মান্না দে, সমর দাশের মতো সংগীতজ্ঞের প্রশংসা আর স্নেহ অর্জন করেছিলেন নিজ যোগ্যতায়। হ্যাপী আখন্দের জন্ম হয় ঢাকার পাতলা খান লেনে ১২ অক্টোবর, ১৯৬৩। জন্মের সময় তাঁর ভাই লাকী আখান্দ তাঁর হাতে একটি পয়সা গুজে দিয়েছিলেন এবং প্রায় ৪-৫ দিন পর তিনি হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফেরার পরও তাঁর হাতে গুজে দেওয়া পয়সাটা ছিল। ছোটবেলায় ভাত খাওয়ার সময় তিনি কাকদের ডেকে ডেকে ভাত খাওয়াতেন। তিনি কোন বিষয় সম্পর্কে একবার শুনলেই মুখস্থ করে ফেলতেন। মাত্র ১০ বছর বয়সে তাঁর হাতে গিটারের তাল ধরা দেয়। শুরুর দিকে হ্যাপী আখন্দ ভাই লাকী আখন্দের সাথে বিভিন্ন কনসার্টে অংশ নিতেন তবলা বাজানোর জন্য।

হ্যাপী আখন্দ 'উইন্ডি সাইড অব কেয়ার' নামে একটি ব্যান্ড গড়েছিলেন যা ছিল একটি পাকিস্তানি ব্যান্ড।সেখানে তিনি দক্ষ হাতে গিটার বাজানোর পাশাপাশি গানও গাইতেন। কলকাতার মধু মুখার্জি ছিলেন তাঁর ছাত্র। ১৯৭৫ সালে 'আবার এলো যে সন্ধ্যা' গানটি লিখেছিলেন এসএম হেদায়েত এবং সুর করেছিলেন লাকী আখন্দ। এই গানটির সংগীত আয়োজন করে হ্যাপী আখন্দ বাংলাদেশ টেলিভিশনে গেয়েছিলেন। লাকী আখন্দের সাথে হ্যাপীর বয়সের ব্যবধান বড়জোর ১০ বছরের হলেও তাঁরা ছিলেন বন্ধুর মতো। ১৯৭২ এর পর ২১ শে ফেব্রুয়ারি ২৬ শে মার্চ, ১৬ই ডিসেম্বর এর মতো জাতীয় উৎসবগুলোতে গণসঙ্গীত পরিবেশন করতো হ্যাপী।

হ্যাপী আখন্দের গাওয়া জনপ্রিয় গান হলো ‘আবার এল যে সন্ধ্যা’, ‘কে বাঁশি বাজায় রে’, খোলা আকাশের মতো তোমাকে হৃদয় দিয়েছি, ‘নীল নীল শাড়ি পরে’, ‘পাহাড়ি ঝরনা’, ‘এই পৃথিবীর বুকে আসে যায়’, স্বাধীনতা তোমায় নিয়ে গান তো লিখেছি’। তাঁর সংগীত আয়োজনে ফেরদৌস ওয়াহিদের গাওয়া ‘এমন একটা মা দে না’, প্রয়াত ফিরোজ সাঁইয়ের গাওয়া ‘ইশকুলখুইলাছে রে মাওলা’ গানগুলো ওই সময় ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। সংগীত পরিবারে জন্ম নেওয়ার ফলে বাবা এবং বড় ভাই লাকী আখন্দের কাছ থেকে পেয়েছেন প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য সংগীতজ্ঞান, আবেশী কণ্ঠস্বরের সঙ্গে সঙ্গে গিটার, পিয়ানো, তবলা সহ বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র বাজানোর সহজাত দক্ষতায় বিস্মিত করেছিল সেই সময়ের শ্রোতা ও শিল্পীদের। 

হ্যাপী আখন্দ সম্পর্কে সঙ্গীতজ্ঞ লাকী আখন্দ বলেন, ‘হ্যাপীর সংগীত-প্রতিভা ছিল আক্ষরিক অর্থেই বিস্ময়কর। সংগীতের প্রতি তাঁর একাগ্র নিষ্ঠা আর ভালোবাসার পাশাপাশি স্রষ্টা প্রদত্ত কিছু সহজাত গুণাবলি ও দক্ষতার কারণে আমরা যারা একই সময়ে সংগীত চর্চা করতাম, তাদের সবার মধ্যে ও ছিল সর্বাপেক্ষা উজ্জ্বল। নিজের সুরেলা কণ্ঠের জাদুতে হ্যাপী শ্রোতাদের হূদয়ের সব বন্ধ জানালা খুলে দিতে পারতেন। গিটার, পিয়ানো, তবলা যা-ই বাজাতেন, এক অদ্ভুত ভালোলাগার জন্ম দিতে পারত তাঁর সংগীত। পৃথিবীর নানা ধাঁচের সংগীত শুনে শুনে ও দেশ-বিদেশের বিভিন্ন গুণী শিল্পীদের সান্নিধ্যে অর্জিত সংগীতের নানা জ্ঞান ও দর্শন অকাতরে বিলিয়ে দিতেন নিজের বন্ধুপ্রতিম সহশিল্পী আর ছাত্রদের মধ্যে। সেই সঙ্গে নিজের দক্ষতা বৃদ্ধি করতে ও নতুনত্ব আনতে হ্যাপী তাঁর উদ্ভাবনী শক্তিকে সব সময় কাজে লাগাতেন। একবার কলকাতার এইচএমভি সংগীত প্রযোজনা সংস্থার একটি গানের রেকর্ডিংয়ে আমি, হ্যাপী ও আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল কাজ করছিলাম। হ্যাপী তবলা বাজানোর সময় শুধু তবলার “বায়া” দিয়ে এমন অদ্ভুত সুন্দর তাল বাজাচ্ছিলেন যে এইচএমভির তৎকালীন পরিচালক কলিম শরাফী রেকর্ডিং রুমে ঢুকে অবাক হয়ে হ্যাপীর বাজানো দেখছিলেন।

হ্যাপীর সংগীত সবাইকে আনন্দ দিলেও তাঁর নিজের জীবন কেটেছে অনেক অভিমান আর কষ্টে।’

২৮ শে ডিসেম্বর ১৯৮৭ সালে তিনি অকালে মারা যান।
 
আজ তাঁর মৃত্যুবার্ষিকী। আজকের এই দিনে তাঁকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি।

Comments

Popular posts from this blog

উপসংহার

আহমদ ছফা